সাংবাদিকতার পাঠ: কিছু কথা কিছু ব্যথা
কিছুদিন আগেও নাকি ছেলে সাংবাদিকতা করে শুনলে মেয়ের বাপেরা বিয়ে দিতে অপারগ হতেন। এমন গল্প হরহামেশাই শোনা যেত। তবে এখন অবশ্য মেয়ের বাবারা এতটা নিষ্ঠুর নন। পেশা হিসেবে কয়েক বছর ধরে সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্বের সাথে সাথে সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় এথানে কিছুটা সুদিন ফিরেছে। তাই মেয়ের বাবারাও এখন মুখ ফিরিয়ে নেন না। ঠিক এ কারণে কি না জানিনা চলতি সময়ে সাংবাদিকতা পেশার প্রতি তরুণদের আগ্রহ বেড়েছে বেশ। গ্ল্যামার বা গণমানুষের কথা বলা-নানা কারণেই এমনটা হতে পারে। আর পেশা হিসেবে সাংবাদিকতায় আগ্রহ বাড়ায়, প্রয়োজন পড়েছে এ বিষয়ে পড়াশোনার। কারণ নইলে তো চান্স পাওয়াটাই মনে হয় মুশকিল হয়ে গেল। তবে বিষয়টা মনে হয় একেবারে বাধ্যতামূলক নয়।
সাংবাদিক হতে গেলে আগে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করতে হবে বোধ করি এমন ধারণা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতায় পড়তে আগ্রহীদের লাইন বাড়ছে। চাহিদায় যোগান দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে, পড়ানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পড়ছেন, পাস করছেন, বেরিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বাধা উতরিয়ে সাংবাদিকতায় সুযোগ পাচ্ছেন, তবে সকলে নয়।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকতায় পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসছেন। অনেকটা পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে সাংবাদিকতা পড়তে আসছেন বলা চলে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পাঠের ইতিহাসটা একটু দীর্ঘ হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্পটা বেশি দিনের নয়। পাবলিক-বেসরকারি মিলিয়ে পাঠটা কেমন চলছে তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কি গণমাধ্যমের উপযোগী মানুষ তৈরি করে দিবে নাকি শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতে শেখাবে এমন কথোপকথনও থেমে নেই। তবে শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের কিছু কথা আছে, কিছু কষ্টের গল্প আছে,কিছুব্যথারবেদনও।
প্রথমত প্রশ্ন আসে, অন্যান্য পেশার মতো সাংবাদিকতাও ব্যবহারিক নির্ভর। এখানে তত্ত্বের কোন জায়গা নেই, আপনাকে কাজটাই করে দেখাতে হবে হাতে-কলমে। সে তুলনায় আমাদের সাংবাদিকতা পাঠ কি স্বয়ংসম্পূর্ণ-এমন প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি ছুড়ে দেয়াই যায়। আমরা সাংবাদিক হবার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যা পড়ছি আর শিক্ষকরা যা পড়াচ্ছেন তার কতখানি আমাদের কাজে আসে, কাজে লাগে। যদি বেশিরভাগই কাজে না লাগে তাহলে কেন বেশিরভাগ অপ্রয়োজনীয় বিষয় পড়ানো হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের গেলানো হচ্ছে।
সাংবাদিকতার সবক্ষেত্রেই প্রয়োজন মূলত ব্যবহারিক কাজের। কিন্তু সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী হয়ে আমরা কি আদৌ সেই সেবা শতভাগ পাচ্ছি? সে প্রশ্ন থেকেই যায়। (দু)ভাগ্যক্রমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাধে অনেকেই আবদ্ধ হয়ে যান শিট কেন্দ্রিক পড়াশোনার ফাঁদে। সাংবাদিকতার পড়াশোনাও এ থেকে বাদ যায় নি বৈকি!
সাংবাদিকতা পড়ানোর ক্ষেত্রে এই বিষয়ে বিজ্ঞ-জ্ঞানী শিক্ষকরাই সাধারণত প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যার মাঝে যে সাংবাদিকতার গণ্ডি থেমে নেই সেটা যেন বিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী বেমালুম ভুলেবসেন।মহামান্য শিক্ষকরা সাংবাদিকতার পাঠ আজ অবধি পাঠ্য বই আর নামমাত্র কাগুজে শিটের মধ্যেই আবদ্ধ করে রেখেছেন।
যে রির্পোটিং শেখার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন বাস্তব ঘটনার সাথে পরিচিত হওয়া, তথ্য জোগাড় কিংবা ঘটনাস্থল পরিদর্শন সে রির্পোটিং শেখার জন্য শিক্ষকবৃন্দের কিছু মুখস্থ বিদ্যার তালিম আর জটিংস ধরিয়ে দেয়ার মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ। তালাশ করলে দেখা যাবে যে রির্পোটিং পড়াচ্ছেন এমন অধিকাংশ শিক্ষকের বাস্তবিক অর্থে রির্পোটিং এর কোন অভিজ্ঞতাই নেই। তবে শিক্ষার্থীদের সফলতা কোথায়?
আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার নিমিত্তে বাংলাতে লেখা বা পড়ার অভ্যাসও ভুলে বসার প্রবণতাও কম কিসে! শিক্ষার্থীদের প্রবণতা তো বাংলায় সাংবাদিকতা করার। যে স্বপ্ন, যে আশা নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা আসছে এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে তাদের অধিকাংশই ইংরেজির প্রবণতায় হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন রির্পোটিংয়ের। শেখানো হয় না অতি প্রয়োজনীয় বাংলা বানানের নিয়ম, ভাষাগত কোন বিষয়াদি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি একাধারে সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়ে অনেক অসঙ্গতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে থাকে সাংবাদিকতায় কি পড়েছি? বাস্তব জ্ঞান উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন হাতে-কলমে শিক্ষা। যা আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকই দিতে নারাজ কিংবা ব্যর্থ। আর শিক্ষার্থীরাও এর ভুক্তভোগী না হয়ে পারে না।
তাই শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝেই আশ্রয় খুঁজেন এই পেশার মানুষদের সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান অন্বেষণের। কিন্তু তাতেও যেন ঘোর আপত্তি প্রিয় শিক্ষকদের। সাংবাদিকতার পাঠ চুকিয়ে যারা এ পেশায় নাম লিখিয়েছেন তাদের দিয়ে কোন প্রকার কর্মশালা করাতেও যেন নারাজ তারা। অথচ এই বাস্তব জ্ঞানের অভাবেই শিক্ষার্থীরা ভোগেন অজানা এক অস্থিরতায়।
পুঁথিগত বিদ্যার দেয়াল ভেঙ্গে সাংবাদিকতার শিক্ষকরা হবেন আরো বাস্তবমুখী। কালো অক্ষরে লেখা বই আর শিট আওড়ে পড়ানোর গণ্ডি পেরিয়ে আসবেন এ কামনা…!
বারেক কায়সার, জিয়াউর রহমান চৌধুরী, সাজিদ আরাফাত
লেখকেরা সংবাদকর্মী ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী